প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ - কিউ. এম. এ. কাদের
১৯৭২ সনের জানুয়ারি মাস থেকে আমাকে এবং আমার কলেজের সেক্রেটারি, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মরহুম শামসুদ্দিন সাহেবকে কলেজের বাউন্ডারির মাঝে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না । কারণ আমরা নাকি মুসলিম লীগের লোক । অর্থাৎ আওয়ামীলীগ করছিলাম না । এক এক করে ৬ মাস – জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন – পর্যন্ত বেতন দিয়ে যাচ্ছে কলেজের স্থানীয় কমিটি।
অথচ- আমাদের কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান জনাব মরহুম গাজী মইজুদ্দিন সাহেব এসব বিষয়ে অবগত ছিলেন না। ইতিমধ্যে আমি চেয়ারম্যান সাহেবের ঢাকা, সিদ্ধেশরীর বাসায় কলেজের একটা জরুরী মিটিং এ ছিলাম । ওখানে সব ঘটনা খুলে বলে আমি কলেজে আর থাকব না, বলতে উনি খুব মনঃক্ষুণ্ণ হলেন এবং বলেন – “ আমি আসছি কোন চিন্তা করবেন না” । আমি যদি কোন কারণে রেগে যেতাম তাহলে কিছুতেই থামাতে পারতাম না । আমি একখানা পদত্যাগ পত্র উনার কাছে জমা দিলাম ।
এদিকে জামালপুর কলেজের গণ্ডগোলের কথা ওপাড়ে পলাশের লোকেরা সবাই জেনে গেছে । আমাকে ওরা বলেছে, প্রিন্সিপাল সাহেবে শুধু নদীটা পার হোন ।যা করার আমরাই করব । আপনাদের কী কী দরকার সবই পাবেন – ইত্যাদি । পলাশের ২/৩ জন স্থানীয় অধ্যাপকও জামালপুর কলেজে ছিল । তারা স্থানীয় চেয়ারম্যান মরহুম নুরুল ইসলাম সাহেবসহ সবাই এবং অর্ধেকের বেশি ছাত্র ছাত্রীও ছিল পলাশের । সকলেই আমাকে নেয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়ালো । সভাপতি সাহেবের কাছে আমি চাকুরীর অব্যাহতি পত্র জমা দিয়ে জামালপুর এসে সেক্রেটারী সাহেবকে বললাম “ভাই সাহেব, আজ জামালপুরের ১২/১৩ বছরের মায়া কেটে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পারে চললাম । আমি যদি ১ মাসের মধ্যে জামালপুর কলেজের ইট, কাঠ সহ এবং ছাত্র –শিক্ষক ওপারে নিতে না পারি, তবে আমার নাম কাদের না ।আমার কথা শুনে মরহুম শামসুদ্দীন সাহেব চিৎকার দিয়ে উঠে আমাকে ঝাপতে ধরে বলে উঠলেন, “ভাই –তুমি তোমার গ্রামে গিয়ে একটি কলেজ কর । পলাশ কর না ।তাহলে জামালপুর কলেজটা থাকবে না ।তাই তুমি পারবে আল্লাহ্ তোমাকে অনেক ক্ষমতা দিয়েছে ।জামালপুর কলেজটা আমার বুকের উপরে থাক – আমি এই ভিক্ষাটা চাই ।”
আমি
তাজ্জব হয়ে গেলাম এবং বলে উঠলাম এই জামালপুর হাইস্কুল, কলেজ এই এতসব কিছু আপনার
–আর কিছু ছেলে- পুলে আপনাকে –আমাকে স্কুলে, কলেজে আসতে
দিচ্ছে না – তাহলে এত দরদ কিসের । তিনি বলে উঠলেন, “তবুও কলেজটা আমার বুকের উপরে
থাক ।” আমি স্থির করে রেখেছিলাম পলাশেই চলে যাব এবং জামালপুরবাসীকে দেখাব কলেজ
কিভাবে করতে হয় । কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেবের কথাশুনে আমার মনে পড়ল খিরাটিতে কিছু
লোকও তো আমাকে অপমান করেছিল এবং আমি চলে এসেছি । পৃথিবীতে কিছু লোক থাকে যারা
মানুষকে অপমান করে, সম্মান করতে জানে না । কিন্তু আল্লাহ্ যাকে চান সম্মানিত
করেন, মানুষ তার কোন ক্ষতি করতে পারে না । সব অপমান ভুলে আবার চিন্তা করতে লাগলাম
নিজের গ্রাম খিরাটিতে কিভাবে কলেজ করা যায় । সে ভাবনা থেকে পলাশ না গিয়ে খিরাটিতে
চলে গেলাম ।তখন না পারলেও পরবর্তীতে ১৮/১৫ বৎসর পরে পলাশ কলেজটি আমিই প্রতিষ্ঠিত
করেছি ।
এর মাঝে একদিন ডাঃ ছানাউল্লাহ মামা বলেছিলেন, এ সময় এম. পি. মন্ত্রী – মিনিস্টার ছাড়া কলেজ করা সম্ভব নয় । এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে –ছাত্রদেরকে নিয়ে এম. পি, মন্ত্রীদের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন মনে করি ।তাই ছাত্রদের নিয়ে ঢাকা যাওয়া ।
১৯৭২ ইং সনের জুন মাসের কথা । আমি তখন ঘোড়াশাল জামালপুর কলেজের অধ্যক্ষ । তখনকার অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন সাহেবকে আমরা জামালপুর কলেজের সংবর্ধনা দিয়েছিলাম ।তাঁকে উপাধি দিয়েছিলাম “বঙ্গতাজ” বলে ।সে কথাটাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ।
যাক সে কথা । খিরাটি গিয়ে স্কুলের ছেলেদের নিয়ে ঢাকায় রওনা হলাম । উদ্দেশ্য জনাব মন্ত্রী সাহেবের সঙ্গে দেখা করে খিরাটিতে একটা কলেজ করার অনুমতি নেওয়া ।এর আগে আমাদের এলাকার কৃতি ব্যক্তি বাংলাদেশের প্রথম এটর্নী জেনারেল মরহুম ফকির শাহাবউদ্দিন আহমদ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার প্রয়োজন মনে করি ।
ঢাকায় আসার পথে আড়াল বাজার হতে জনাব মরহুম সাদির মোক্তার সাহেবের লঞ্চে ঘোড়াশাল পৌছি ।ঘোড়াশাল ষ্টেশনে ছেলেদের হোটেল থেকে সিংগারা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় ।হোটেলের মালিক জনাব মরহুম কালা মিয়া ছাত্রদের খাওয়ান ।তারপর ট্রেনে উঠার পালা । ষ্টেশন মাস্টার আমার পরিচিত ।তিনি ব্যবস্থা করলেন, লোকাল ট্রেনটি পরে আসবে –তখন যেন ছেলেদের নিয়ে ট্রেনে চড়ি ।কিন্তু মেইল ট্রেনটি ষ্টেশন দাঁড়ানোর সাথে সাথে ছাত্ররা হুড়মুড় করে গাড়ীতে উঠে গেল – কে শুনে কার কথা । তখন গাড়ীর গার্ড সাহেব জানতে চাইলেন ছাত্রদের টিকেট হয়েছে কিনা ।আমি বললাম না । তখন গার্ড সাহেব বললেন তাহলে – আপনাদের তেজগাঁও ষ্টেশনে নামতে হবে । আমি বললাম যে আমরা তেজগাঁও ষ্টেশনেই নামব । এতে গার্ড সাহেব আশ্বস্ত হলেন ।
তেজগাঁও নেমেই আমরা সবাই পায়ে হেঁটে ধানমণ্ডির শাহাবুদ্দীন
সাহেবের বাসার দিকে রওনা দেই ।ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে উনার ধানমণ্ডির বাসায় হাজির হই
। আমাদের দেখে শাহাবুদ্দীন সাহেব খুব
নাখোশ হলেন ।খিরাটিতে কলেজ করার ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করে বিভিন্ন ধরনের
নেতিবাচক মন্তব্য করে অতিদ্রুত বাসা থেকে
বের হয়ে তিনি নিজস্ব কাজে চলে যান ।তখন অনেকটা বাধ্য হয়েই মন্ত্রী পাড়ায়
অর্থমন্ত্রী মরহুম জনাব তাজউদ্দিন সাহেবের বাসায় ১২৫ জন ছাত্র নিয়ে রাত ১২ টার
দিকে হাজির হই ।ছাত্রদের মধ্যে মনে পড়ে চান মিঞা, আঃ আউয়াল,নুরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর
– বিন-হামিদ ।ছেলেদের মধ্যে মাতাব, মতি মিঞা, মনি, ফজলু – আরও অনেকে সবার নাম তো এখন এর মনে নেই ।মরহুম
তাজউদ্দিন সাহেব আমাদেরকে খুব আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করলেন এবং আমাদের কথা শুনলেন
।শুনে বললেন, “মনোহরদী কলেজটি তোমার কলেজটিকে খেয়ে ফেলবে ।” অর্থাৎ করতে দিবে না
তিনি ভেবেছিলেন ।
কিন্তু পিড়াপিড়ি করতে তিনি বললেন, “কলেজ করতে পারলে কর – ভাল ।” আমি ঘোড়াশাল ষ্টেশনে বসে ৫ পয়সা দামের এক তা’ কাগজ কিনে একটা দরখাস্ত লিখে রেখেছিলাম । সেটা জনাব মন্ত্রী সাহেবের সামনে ধরে বলেছিলাম – “আপনি একটা কিছু লিখে দিন ।” মরহুম মন্ত্রী সাহেব কাগজের এক কোনায় লিখলেন – “খিরাটিতে কলেজ করার ব্যাপারে আমি সকলের সাথে একমত ।সাধ্যমত সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ।” এই লিখে নিচে সই দিলেন – তাজ আহমেদ ।তখন উপস্থিত যুবকরা আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং তাজউদ্দিন সাহেবের নামে স্লোগান দিতে থাকে ।রাত তখন প্রায় ২ টা । আমি সবাইকে বলি বাবারা তোমরা থাম ; এখন অনেক রাত । সেই দরখাস্ত তো মন্ত্রীর দস্তখতসহ আবেদন পত্রটি কোথায় হারিয়ে গেছে মনে নেই । এত রাতে ছেলেদের নিয়ে কমলাপুর ষ্টেশনে পৌছাই ।
সেই রাত দুপুরে জনাব তাজউদ্দিন সাহেবের বাসা হতে কমলাপুর
রেল ষ্টেশনের উদ্দেশে রওনা হলাম ।মন্ত্রী মহাদয় একখানা নাইট পাশে ছিলেন যাতে
রাস্তায় কোন অসুবিধা না হয় । মিন্টু রোডের মন্ত্রীর বাড়ী হতে রাত ২ টায় হেঁটে এসে
ষ্টেশনে পৌছলাম । এত রাতে কোন হোটেলেই কোন খাবার নেই ।আর এত গুলি ছেলের খাবার
কেইবা প্রস্তুত করে রাখে । ৪/৫ টা হোটেল থেকে কিছু ভাত ডাল যোগাড় করে ওদেরকে
খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো ।সেই গতকাল সকালে বাড়ী থেকে ছেলেরা খেয়ে এসেছিল, আর এখনও
পর্যন্ত কোন ভাত তাদের পেটে পরেনি । সত্যিই অনেক কষ্ট আমার গ্রামের ছেলেরা এই
কলেজের জন্য মাথা পেতে নিয়েছিল । কিছু খাওয়ার
পর ষ্টেশনে এখানে সেখানে ছেলেরা বসে রইল । আর আমি একখানা
খবরের কাগজ পেতে মেঝেরে শুয়ে পড়লাম ।ভোর পাঁচ (৫) টায় লোকাল
ট্রেন । সব ছেলেদের টিকেট করতে হয়েছিল কি না মনে নেই তবে সকলেই ট্রেনে উঠে পড়ল
।যথা সময়ে ট্রেন ছাড়ল ।ওদেরকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আমি ষ্টেশনেই রইলাম ।ফজরের নামাজ
পড়ে আমি ডাঃ ছানাউল্লাহ সাহেবের বাসায় পৌছালাম । ডাঃ ছানাউল্লাহ সাহেবকে গতকালের
সব ঘটনা খুলে বললাম । তাঁকে বললাম কলেজের জন্য একটা হ্যান্ডবিল ছাপাতে বললেন ।
ছাপালাম হ্যান্ডবিল । কলেজের কাজ শুরু করেছিলাম । ১ দিন পর খিরাটি গেলাম ।খিরাটিতে কলেজের জন্য মিটিং দিলাম ।লোকজন এলো কিন্তু হাতে গোনা কয়জন ।আর আমরা ছাত্ররা সব ।প্রথম মিটিং এর সভাপতি হতে সহজে কেউ রাজী হলেন না । চর দুলর্ভখাল ডাঃ মরহুম আঃ আউয়াল সাহেবকে দিয়ে সভাপতির কাজ চালিয়ে দিলাম । গ্রামের লোকেরা মনে মনে হাসে- আবার মরুব্বী শ্রেণীর সবাই বলে – এ কাদিরের পাগলামী ।”
যেই যা বলুক, কলেজ শুরু করেছি অতএব এ কাজ শেষ করতেই হবে ।আল্লাহ তায়ালার অসীম রহমত এই ছিল যে খিরাটি হাইস্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে একজন প্রধান শিক্ষক জনাব এ. হাসেম – বাংলায় এম. এ । ২ জন সহকারী শিক্ষক জনাব গোলাম রব্বানী ইসলামের ইতিহাস – এম . এ । বাবু নারায়ন চন্দ্র ছিলেন কমার্সের ব্যবস্থাপনায় এম কম । এর আমি একজন । ঐ মোট ৪ জন অধ্যাপক কাজ শুরু করে দিলাম । ঘর দরজা নেই । হাই স্কুলের সামনে কাঁঠাল গাছের নিচে স্কুল থেকে বেঞ্চ টুল বের করে কলেজের ক্লাস শুরু হলো । কলেজের সেশন – ১৯৭২ -৭৩ ইং সনে প্রথম শুরু । ছাত্র –ছাত্রী ভর্তি শুরু হলো । মানুষের হাতে পায়ে ধরে ছাত্র/ছাত্রী ভিক্ষা আরম্ভ হলো ।এর মধ্যে জনাব তাজউদ্দিন সাহেবের কাছে যেয়ে বললাম ছাত্র –ছাত্রী ভর্তি শুরু করে দিয়েছি । তিনি বললেন, “কলেজের ঘর দরজা, জায়গা জমি সব কিছু না হলে তো সরকারী স্বীকৃতি পাওয়া যাবে না ।এ সব ঠিক করে পরে আস ।” ছাত্র/ছাত্রী ভর্তির পাশাপাশি শুরু হলো ঘর, টুল, বেঞ্চ, জায়গা-জমির ব্যবস্থা করন ।আমার মরহুম পিতা কাজী মোঃ আঃ বাছির ও মরহুম চাচা মোশাররফ হোসেন সাহেবকে ধরলাম তাদের জমির একটু (কলেজের মাঠে অবস্থিত ছিল) দেওয়ার জন্য । তারা কলেজের নামে লিখে দিলেন । আমার খরিদ করা ২ বিঘা জমি কলেজের নামে লিখে দিয়েছিলাম । যা এখন এর নেই । নদীতে ভেঙ্গে নিঃশেষ হয়ে গেছে ।আমার ছোট ভাই কাজী আঃ বাকীর শ্বশুর মরহুম জনাব আহাম্মদ আলী সাহেবের একখণ্ড জমি কলেজের মাঠে ছিল । ওর কাছ থেকেও হাতে পায়ে ধরে জমিটুকু কলেজের নামে নিয়ে নেওয়া হয় । এভাবে জমি নেওয়ার পরও বোর্ডের নিয়মানুযায়ী ৫ (পাঁচ) একর জমি না হলে কলেজের মঞ্জুরী পাওয়া যাবে না । জমি না হলে মন্ত্রী সাহেবকে কলেজের সরকারী স্বীকৃতির জন্য কিছু বলতেও পারছিনা ।
শেষ পর্যন্ত আঃ হাই এর মরহুম মা’র বাপের বাড়ীর সম্পত্তিতে হাত দিতে হলো । খিরাটি দক্ষিণ পাড়ার মরহুম আঃ ছাত্তার মাঝি সাহেবের জমি মামলা করে আঃ হাই এর মা’র নামে নিয়ে পরে কলেজের নামে আঃ হাইদের বাড়ীতে কমিশন এনে রেজেস্ট্রি করে নিয়েছিলাম । এত সব করেও জমি ১৫ (পনের) বিঘা হয় না । পরে কলেজের পশ্চিম পার্শ্বের মরহুম মুজাফফর ভাই এর বোন জামাতার (মুঙ্গুইরা মুন্সী )কাছ থেকে প্রায় ৩ বিঘা জমি কলেজের নামে রেজেস্ট্রি করে নিয়েছিলাম ।এতসব করতে অনেক কষ্ট, অনেক চাল চালতে হয়েছিল – যা গ্রামের অনেকেই জানেন না ।
আপনারা হয়ত অনেকেই
জানেন কলেজের মাঠে আমার চাচাদের মরহুম হাজী জহিরউদ্দিন বেপারী, মরহুম হাজী জোনাব আলী ও মরহুম এনায়েত আলী সাহেবদের জমি ছিল ।তাদের
অবর্তমানে তাঁদের ছেলেমেয়েরা কলেজের জমি দিতে মোটেই ইচ্ছুক ছিলেন না । পরবর্তীতে
তাদের ন্যায্য মূল্য দিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ জমি কলেজের জন্য নিয়েছেন । আরো যারা জমি
কলেজের নামে করেছিলেন – তাদের সকলকেই জমির মূল্য বাবদ কিছু না কিছু দেওয়া হয়েছে ।
তবে আমার বাপ –চাচার প্রদত্ত জমির মূল্য বাবদ কিছুই নিইনি ।
জমির দলিলের কাগজপত্র বোর্ড অফিসে জমা দেওয়া হলো । শিক্ষক স্টাফ এভাবে সেভাবে দেখানো হলো । হাতিয়া দিয়ে কলেজ হতে ইংরেজী পড়ানোর জন্য প্রোফেসার আঃ কাদির সাহেবকে পার্টটাইম নিয়োগ দেওয়া হয় ।মনোহরদী কলেজের সাথে সংগত কারণে ভাব খুব রাখা যায় না ।আশা করি বুঝতে কষ্ট হবে না ।
এত গেল জমি, কলেজ স্টাফ – কিন্তু আসল কাজ কলেজ গৃহের বন্দোবস্ত এখনও হয় নাই । এখনও হাই স্কুলের ২/৩ টা রুম এবং গাছ তলায় কলেজের কাজ চালানো হচ্ছে । কলেজ ঘর তৈরির জন্য দেওয়া হল এক বিরাট পরিকল্পনা । স্কুল মাঠের পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর দক্ষিনে লম্বা লম্বি ভাবে ৩০০/৫০০ হাত লম্বা একখানা ঘর তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়ে স্কুলের ছাত্র, কিছু উৎসাহী শিক্ষক এবং গ্রামের ছাত্র সকলকে নিয়ে কাঠ, বাঁশ সংগ্রহের অভিযানে নেমে পড়লাম । কলেজের জন্য নিবেদিত প্রান আঃ আউয়াল সাহেবের বাড়ীতে একটি শতবর্ষের পুরাতন আম গাছ ছিল ।কলেজের জন্য কেটে ফেলা হল । আমাদের বাড়ী হতে শুরু করে প্রায় সকলের বাড়ীর রয়না গাছ কাটা হতে বাদ দিইনি । দক্ষিণ পাড়ার সিদ্দিক মিঞাদের বাড়ীতে একটি অতি পুরাতন তাল গাছ ছিল । কলেজের রুয়ার জন্য নিয়ে আসা হলো । পশ্চিম পাড়ার সূতীর পারের রহমানদের বাড়ীর একটি তাল গাছ কেটে আনা হলো । আরও অনেকের অনেক গাছ কেটে নিয়ে এসেছি ।আপনারা শুনলে অবাক হবেন – আমি সকালে হাত করাত ওয়ালা ২ জন করাতি নিয়ে কাঠের সন্ধানে বের হতাম ।এর মধ্যে একটি ঘটনা মনে পড়ল । মরহুম মাওলানা আঃ রশিদ সাহবের বাড়ীর সুফির বাপের একটি রয়না গাছ কাটাতে গেলে বাধা প্রাপ্ত হই । চাঁন মিঞার বাবা মরহুম হাজী সাহাবুদ্দিন সাহেবকে তারা ধরলেন যেন গাছ কাটা না হয় । গাছটি নাকি ৭০/= টাকা দাম উঠেছে ইত্যাদি --------- । কিন্তু হাজী সাহাবুদ্দিন সাহেব আমাকে গাছ না কাটার অনুরোধ করে চলে যাবার পর আমি করাতি দিয়ে গাছ কেটে ফেললাম । বিরাট গাছ হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে গেল ।গাছ ওয়ালা দৌড়ে এসে – দূর থেকে বললেন – আমি যেন গাছের লাকড়ী ইত্যাদি না নেই ।আমরা শুধু গাছের গোঁড়াটুকু নিয়েই চলে এসেছি ।আমাদের গ্রামে একটা ত্রাস ছিলাম আমি ।আমাকে দেখলেই বলতেন –“এই সারছেরে গাছ বুঝি আর থাকল না” ।এই যে সকলের নিরব সহযোগিতা যা না হলে এত বড় একটা ঘর করতে পারতাম না । মহান আল্লাহর দরবারে এই প্রার্থনা যারা এই কলেজের জন্য এত আত্মত্যাগ করেছেন – তাঁদের যেন বেহেশত নসীব হয় ।
কথায় কথায় আরও একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল ।একদিন মোল্লা বাড়ীর পূর্ব পাশের বাগানের ভিতর একটি তালগাছ কেটে ফেললাম ।সাথে ছিলেন জনাব আলহাজ্ব এম. এ হামিদ বি. টি. সাহেব । গাছের মালিক দৌড়ে আসলেন ।আমাদেরই লোক জনাব আঃ আওয়াল ও ডাঃ আঃ রউফ আকন্দ ।তারা গাছ দিতে মোটেই রাজী নন ।আমি অনেক অনুনয় বিনয় করে বললাম -আপনারা যদি গাছ না দেন তাহলে আর কাউ গাছ দিবে না । অনেক তর্কাতর্কির পর বি. টি সাহেব বললেন – “কাদির গাছ দিয়ে দাও ”। আমি চলে আসার সময় শুধু বলে এসেছিলাম – “ভাইসাব শত শত গাছ যোগাড় করেছি – কিন্তু কেউ কোনদিন এভাবে নিয়ে যায়নি ” ।আপনাকে নিয়ে যদি কাঠ সংগ্রহে বের হতাম তা’হলে কলেজ ঘর হতো না ।বি. টি সাহেব শুধু হাসলেন । ডাঃ ছানাউল্লাহ সাহেবের মরহুম পিতার সাথে কাটা গাছ নিয়ে একদিন আমার ধস্তাধস্তি হয়েছিল । তবে গাছ দিয়েছিলেন ।
কলেজের বাঁশ সংগ্রহের জন্য সুদূরে সিংগুয়া পর্যন্ত গিয়েছি । সিংগুয়া কয়ার বাড়ীর খালের টানের বাড়ীতে বাঁশ কাটতে গিয়ে আমার এক ছেলের হাত বেশ খানিকটা কেটে যায় । এ জন্যই এসব কথা মনে পড়ে ।
কলেজের কাঠের জন্য স্থানে স্থানে করাতি লাগানো হলো কাঠ প্রায় রেডি । এখন অল্প টাকায় মিস্ত্রী জোগাড় করা দরকার ।আমার চাচাত ভাই ভাল কাঠ মিস্ত্রী আরমান মিঞাকে সকলে মিলে ধরলাম । সে তার দলবল নিয়ে রাজী হলো ।৩৫০ হাত ঘর । চারটি ভাগে ভাগ করে কাঠের ফ্রেম তৈরি করে ফেললো । এখন বাঁশের খুঁটির সাথে কিছু কাঠের খুঁটি না হলে চলে না ।কথায় পাই কাঠের খুঁটি ।আমার শ্রদ্ধেয় ভাই আলহাজ্ব মোঃ দানেশ সাহেবের ঘরের জন্য ১৬ টি খুঁটি পুকুরে ডোবানো ছিল । ছেলে পেলে লাগিয়ে সেগুলো নিয়ে আসা হলো । সে সময় দানেশ ভাই সাহেব বাড়ী ছিলেন না । কাজেই মরহুম ইউনুস ভাই সাহেব এসে বাধা দিলেন । কিন্তু বাধা দেয়ার আগেই গাছ কাঠের খুঁটি হয়ে মাটিতে পুঁতে গেছে । সে দিন বাজারের দিন ছিল । বাজারের সব মানুষের সাহায্যে সব ঘর উপরে উঠানো হলো ।
ঘরের চালা তো উপরে উঠানো হলো কিন্তু এখন টিন কোথায় পাই । টিনের ছাওনি দিতে হবে অবশ্যই ।............... প্রত্যেক সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় দেওয়া হয় শুনেছি । এবং আরও শুনেছি যে, কাপাসিয়াতে আমাদের জনাব ফকির সাহাবুদ্দিন সাহেবের মাধ্যমে টিন দেওয়া হচ্ছে । দৌড়িয়ে কাপাসিয়া গেলাম দিনের আশায় । ফকির সাহেবকে পেলাম কিন্তু টিন পেলাম না । তিনি বললেন –“তোমাকে কোথায় টিন দিব – এলাকার মসজিদ মাদ্রাসার জন্যও টিন দিতে পারছি না – কি আঙ্কেল তোমার ?” ঘরের ছাউনির অভাবে কাঠ ফেরে চৌচির হয়ে যাচ্ছে । কাপাসিয়াতে টিনের কোন ব্যবস্থা না হওয়াতে পাগলের মত ঢাকা ছুটে গেলাম ।ঢাকায় পৌছাতে প্রায় ২ টা বেজে গেল ।মন্ত্রী সাহেবের অফিসের নিচে পৌঁছেছি তিনি তখন সবে মাত্র তার দফতর থেকে লিফটে নেমে গাড়ীতে উঠতে যাচ্ছিলেন । আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন কি খবর ।আমি খিরাটি থেকে শুরু করে কাপাসিয়ার সব ঘটনা খুলে বললাম – শুনে তিনি বললেন ,- “পাগলরে আমার, কলেজ কলেজ করে শেষ হয়ে যাবিরে । আগামিকাল ১০ টার মধ্যে আমার অফিসে এসো দেখা যাক তোমার জন্য কিছু করা যায় কি না ।” বলেই তিনি চলে গেলেন ।ঐ দিন রাত আর শেষ হয় না । পরদিন ১০ টা বাজার আগেই মন্ত্রী মহাদয়ের অফিসে গিয়ে হাজির ।মন্ত্রী সাহেব বললেন –“একটু হাতের কাজটা সেরে নিই” । ১০ টা ১৫ মিনিট পর তিনি ফোনে কথা বলতে লাগলেন আমি শুনছি । তিনি বলছেন –“ভাই সাহেব বড় বিপদে আছি ।আমার ২টা কলেজ ১টা থানা হেড কোয়াটারে – যার কোন বোডিং হাউস নেই । আর একটা থানা থেকে অনেক দূরে ।ওটার কোন ঘরই নেই ।ঐ কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেব আমার সামনে বসা ।” – এ সব কথা বলার পর তিনি কি কি শুনলেন পরে বললেন – “তকে পাঠিয়ে দেব এক্ষুনি ঠিক আছে – খুব খুশি হব – আচ্ছা” এই বলে ফোন রেখে আমাকে বললেন – “ঐ উত্তরের ৯ তলার বিল্ডিং এর ২য় তলায় রিলিফ মিনিস্টার কামরুজ্জামান সাহেবের অফিস চেন – এখনই যাও – ওনার সঙ্গে দেখা কর ।দেখ কি করেন তিনি ।” বলেই মন্ত্রী সাহেব পিয়নকে ডেকে এনে আমাকে তার সঙ্গে দিয়ে বললেন –“যাও প্রিন্সিপাল সাহেবকে মন্ত্রী সাহেবের অফিসে দিয়ে এস ।”
পিয়ন আমাকে রিলিফ মন্ত্রী সাহেবের অফিসে পোঁছে দিয়ে চলে গেল । আমি বসে রইলাম পি. এস সাহেবের রুমে ।তিনি জিজ্ঞাসা করলেন কি চাই ? । আমি বলছি মন্ত্রী সাহেবের সাথে দেখা করব । কিন্তু তিনি কিছুই বলেননি ।অনেক্ষন কেটে গেল । রিলিফ মিনিস্টার সাহেব আমাদের অর্থমন্ত্রী সাহেবের সাথে হয়ত ফোনে আমার কথা জেনে নিয়ে নিজেই উঠে পি. এস. এর রুমে এসে আমাকে দেখেন, আমাকে যেতে দেয়া হয়নি কেন বলে পি. এস. এর উপরে রেগে গেলেন ।
যাক, মন্ত্রী সাহেবের কাছে নিয়ে আমাকে বসালেন । তিনি আমাকে বললেন, -“স্যার আমি আপনার জন্য কি করতে পারি ?” সত্যি আমি মুগ্ধ হলাম মন্ত্রী মহোদয়ের ব্যবহার দেখে । তাঁকে আমি সব খুলে বললাম ।তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর একজন পি. এস কে ডেকে এনে একজন ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে আনতে বললেন । ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমার কাছে শুনলেন – ৩৫০ হাত ঘরের ঢেউ টিনের প্রয়োজন ।তিনি বললেন – ৫০ বান্ডেল টিন দরকার ।তখন মন্ত্রী সাহেব আমাকে বললেন, ৫০ বান্ডেল টিন আপনাকে দেওয়া গেল, আমি বললাম, “স্যার ঘরের বেড়া সহ দিয়েছেন তো ? মন্ত্রী সাহেব বললেন, না – শুধু ছাউনির জন্য ।” তখন আমি বললাম স্যার বেড়া দেব কি দিয়ে ? মন্ত্রী বললেন, - “মলি বাঁশের বেড়া দিয়ে দেবেন ।” আমি বললাম - “স্যার আমাদের ভাওয়ালের লাল মাটি ২/১ মাসের মধ্যে উইপোকায় খেয়ে ফেলবে ।” মন্ত্রী মহোদয় একটু চিন্তা করে বললেন ,তা হলে আরও ১০ বান্ডিল দিয়ে দিই ?” আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, “দেন স্যার”। মন্ত্রী মহোদয় ১ জন সেকশন অফিসারকে ডেকে বলে দিলেন এক্ষুনি চিঠি তৈরি করে এস-ডি ও নর্থ ঢাকা ও প্রিন্সিপাল বঙ্গতাজ কলেজ খিরাটিকে হাতে হাতে দিয়ে দেওয়া হউক । চিঠি রেডি করতে প্রায় ১ টা- দেড়টা বেজে গেল । আমি চিঠি নিয়ে এস –ডি ও সাহেবের অফিসে –অফিসে ছুটি হইবার আগেই হাজির হই ।এস –ডি –ও সাহেবের অফিস থেকে নারায়নগঞ্জ সি –এস –ডি গোডাউনকে চিঠি দিয়ে আমাকে হাতে হাতে দিয়ে দিলেন । আমি চিঠি পেয়ে শুধু এক দৌড়ে আকেবারে নারায়ণগঞ্জ সি –এস –ডি গোডাউন এ পৌছাই ।তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে । গোডাউনের অফিসার শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারে মদনগঞ্জে অফিস কোয়াটারে থাকেন ।তিনি অনেক আগেই বাসায় চলে গেছেন । আমি ফেরি দিয়ে নদী পাড় হয়ে ওপাড়ে গেলাম । মাগরিবের নামাজ পড়ে সাহেবের বাসায় গেলাম চিঠি দিলাম । আমার পরিচয় দিলে তিনি আমাকে খুব খাতির করলেন ।তাঁকে আমি বললাম “স্যার আমাকে আপনার মনের মত টিন দিবেন । শুধু রিলিফের টিন দিবেন না।।
মোটেই চিন্তা করি নাই । যে যা পারছে টা দিয়েই ভর্তি করে নিয়েছি । ৪০০ শত
ছাত্র/ছাত্রী ভর্তি করা চাট্টিখানি কথা নয় । ছাত্র/ছাত্রীদের কাছ থেকে যে টাকা
নিয়েছিলাম ওগুলি সব তাদের নাম রেজিস্ট্রেশান করতেই লেগেছে । এই বেহিসেবী ভর্তির টাকা এবং
তাদের নাম রেজিস্ট্রি ও বোর্ডের খরচ মেটানো টাকার হিসাব মেলাতে গিয়েই আমার জীবনে
কাল করে দাঁড়িয়েছিল । পরবর্তী পর্যায়
৫০/৬০ হাজার টাকা চুরির অপবাদ নিয়ে নিজ গ্রামে নিজের হাতে গড়া কলেজ থেকে বিনা
অপরাধে শুধু গুটি কতক পরশ্রীকাতর মানুষের যুক্তিহীন কথায় আমাকে কলেজ ছেড়ে আসতে
হয়েছিল । গ্রামের একজন মুরুব্বীকে এ ব্যাপারে আমি ঢাকা এসে ডাঃ ছানাউল্লাহ সাহেবকে
খুলে বলার পর তিনি শুধু একটা ছোট্ট পত্র লিখে দিয়েছিলেন – “মামা কাদিরের ব্যাপারে এতটুকু
করা ঠিক হয় নি ।”
যাক ওসব অনেক কথা – সব লিখলে বিরাট উপন্যাস হয়ে যাবে । আমার শুধু একটি কথাই মনে পড়ে । খিরাটিতে আমার কলেজ করাটা অন্যায় হয়েছিল কিনা । কারণ আমি জীবনে ২ টা হাইস্কুল ৭টা কলেজ করেছি । কোথাও ৭ টাকা চুরি করার সুযোগ পাইনি, শুধু খিরাটিতেই এ সুযোগ ছিল ।১৯৭২ ইং সন থেকে ১৯৮২ ইং সন পর্যন্ত দীর্ঘ ১০টি বছর আমাকে কত বেতন দেওয়া হয়েছিল – এ খবরটি কেউ কোনদিন নেয়নি ।আমি খিরাটি হতে চলে আসার পর কলেজের কোন এক সমাবেশে গ্রামের কোন এক উৎসাহী লোক আমাদের গ্রামের ডাঃ আবুল হাসান সাহেবকে কথার মাঝে বলেছিল কাদের প্রিন্সিপাল এতগুলো টাকা কলেজ থেকে মেরে দিয়েছে কেমন হল ? – তখন ডঃ আবুল হাসান বলেছিলেন” “ বেশিদিন তো হয়নি এখনি আপনাদেরকে ৬০ লক্ষ টাকা দেওয়া হলে এমন একটা কাজ কলেজ করতে পারবেন তো ?” একথা শুনে সেই লোক চুপ মেরে গেল এর মুখ খুলল না । শুধু তাই নয়, আমি খিরাটির কিছু লোকের কাছ থেকে পেয়েছি তাঁর চেয়ে বেশি অনেক বেশি সম্মান পেয়েছি পরবর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে । ১৯৯৬ সালে খিরাটি স্কুল মাঠে এক ফুটবল টুর্নামেন্ট ফাইনাল খেলায় (যে টুর্নামেন্টের কমিটির সভাপতি ছিল আমার ভাতিজা জামাল উদ্দিন আহমেদ) আমাকে প্রধান অতিথি করে নিয়ে আসা হয় । এসে দেখি সেখানে আমার কলেজ প্রতিষ্ঠাকালীন কিছু সৈনিক যেমন চান মিয়া, নুরুল ইসলাম, ছানাউল্লাহ, ছিদ্দিক, মনি মিয়া, মাহতাব সহ আরও অনেকে আমাকে স্বাগত জানানোর নানাবিধ ব্যবস্থা করেছেন । তাদের নেতৃত্বে আমার বাড়ী থেকে মাঠের মঞ্চ পর্যন্ত বিশাল মিছিল সহকারে আমাকে মঞ্চে নিয়ে যায় ।আমি আবেগে আপ্লুত হলাম । আবারও মনে হল খিরাটিবাসির কত উঁচু মনের অধিকারী । তারা সম্মানিত ব্যক্তিকে সম্মান দিতে জানে ।
যাক দক্ষিণ পাড়ার জনাব শুক্কুর আলী মেম্বার, পাহলোয়ান, কে কে জীবিত আছেন জানি না । তাঁরা থাকলে বলতে পারতেন আমার খিরাটি জীবনের
দৈনিক জীবন-যাত্রা সম্পর্কে । চর খিরাটি ৪/৫ বিঘা ধানের জমির বদৌলতে
আমার বাড়ীতে কলেজের দুই দুই জন প্রফেসর মাসকে মাস রাখা অবশ্য কষ্টই হয়েছিল । তখন নতুন অবস্থায় সরকারী কোন অনুদান পাওয়া
যেত না । পরবর্তীতে
কলেজে অধ্যাপকের জন্য মেস করার ব্যবস্থা করেছিলাম । তবুও ২ জন প্রফেসর ফরিদপুরের ফজলুল হক ও রাজশাহীর একজন । আমার বাড়ীতে বেশ কিছুদিন ছিলেন ।কত কষ্ট করে টুল-টেবিল চেয়ার-আলমারি তৈরি করে চার পাঁচশত ছেলে-মেয়েদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল । মঞ্জুরি আনতে ঢাকা আর খিরাটি দৌড়াদৌড়ি করতে করতে প্রাণান্তকর
অবস্থা হয়েছিল । এতে আমার
জীবনের গতিই পরিবর্তন হয়েছিল । অভিজ্ঞতা
কাকে বলে বিশেষ করে তিক্ত অভিজ্ঞতা অনেক অর্জন হয়েছিল ।
এইচ.এস.সি পরীক্ষার কেন্দ্র আনার ব্যাপারে কত যে কষ্ট করতে হয়েছিল টা আমার জীবনে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ।থানা হেডকোয়াটার ছাড়া কোন পরীক্ষা কেন্দ্র দেয়ার নিয়ম ছিল না ।তবুও মন্ত্রীর নামে কলেজ বলে কথা । তারপর মনোহরদী কেন্দ্রের একগুঁয়েমির কারণে প্রথম দিনের পরীক্ষা ১০টার পরিবর্তে ২টায় দিতে হয়েছিল ।সেই মনোহরদী কেন্দ্রে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সে কি কান্না । জানিনা কেন ছেলে-মেয়েরা বিমর্ষ হয়েছিল । হয়তো ভীতের কারণে, নানা প্রকার তিরস্কার মূলক কথায় । আজ আমার একটা কথা মনে পড়ে মরহুম বি. টি সাহেব আমাকে বলেছিলেন, “কাদের যদি তুমি আগামী দিনের পরীক্ষার আগে খিরাটিটে কলেজ কেন্দ্র আনতে না পার তবে তুমি কিসের প্রিন্সিপাল ? ” বললাম, “ভাই সাহেব, আপনি দোয়া করবেন, আমি যেন পরীক্ষার আগে কেন্দ্র নিয়েই বাড়ী ফিরতে পারি ।” পরদিন শুক্রবার ঢাকা চলে এলাম । শনিবার মাত্র ১ দিন অফিস খোলা । ঐ দিন মন্ত্রী সাহেব ঢাকা ছিলেন না । এস.ডিও সাহেবের পেশকারের কথায় মন্ত্রী সাহেবকে ফোনে বললাম – ভাই সাহেব দয়া করে A.D.C সাহেবকে বলে দিন আমার কথা । তখন মন্ত্রী সাহেব বললেন, “আরে কাদির, তুমি আমাকে আর কোথায় নামাবে ।” তুমি এক্ষণই নারায়ণগঞ্জ এস.ডি.ও সাহেবের সাথে দেখা কর । সে মতে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে রাত ৮টায় পৌঁছি । নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে দেখি এস.ডি.ও সাহেব আমার জন্য অপেক্ষা করেছেন ।এস.ডি.ও সাহেবকে দিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রের আদেশ নিয়ে রাত ৯টার সময় নারায়ণগঞ্জ থেকে রওয়ানা দিয়ে হাতিরদিয়া রক্ষী বাহিনীর কমান্ডার সাহেবের চিঠি এবং মনোহরদী কলেজের প্রিন্সিপালের চিঠি রাতেই পৌঁছে দিয়ে আসি । কারণ সকাল ১০ টায় পরীক্ষা । পরদিন সকাল ১০টার আগেই মনোহরদী কলেজের অধ্যক্ষ সাথে প্রশ্নপত্র, পুলিশ বাহিনী এবং হাতিরদিয়া থেকে রক্ষীবাহিনী সবাই এসে হাজির । এবং যথারীতি আমার বঙ্গতাজ কলেজের পরীক্ষা শুরু হয় ।কলেজ কেন্দ্রের ইনচার্জ ছিলেন মনোহরনী সাব রেজিস্ট্রার সাহেব । এই কস্তটা তাঁরা আমাকে না দিলেও পারত ।কিন্তু তাঁরা থানা হেডকোয়াটার, বড় কলেজ্র দাবিদার, যাক আল্লাহর রহমতে আমিও কম গেলাম কই ? এই তো গেল পরীক্ষার কথা ।
কলেজের কোন ভাল আলমারি নেই । ঢাকার ইংলিশ রোডের ইউনুস মার্কেট এর ভদ্রলোককে ধরে ২টা স্টিলের আলমারি যোগাড় করলাম ।নতুন স্বাধীন দেশ । ভারত সরকার কিছু বই কলেজের লাইব্রেরীর জন্য অনুদান হিসেবে দিলেন ।সেগুলো চিটাগাং থেকে আনতে হয়েছিল ।এক রোজার বন্ধের সময় উইপোকা অনেকগুলি বই নষ্ট করে ফেলেছিল ।
এতসব চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ধীরে ধীরে কলেজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি । এর মধ্যে দুষ্টক্ষতের মত একজন অধ্যাপককে আমার এক ভাগ্নে পশ্চিম পাড়ার নান্নু মিয়াকে (বোরহান উদ্দিন) কলেজের জন্য নিয়ে আসে ।কলেজের অধ্যাপক কম থাকায় নিয়ে নিলাম । ওই ভদ্রলোক ডিগ্রীতে, অনার্স-মাস্টার্স ছিলেন না । তখন ডিজি থেকে একটা সার্কুলার এলো যাদের ডিগ্রীতে অনার্স নেই তাঁরা যে কলেজে আছেন সেখান থেকে অন্য কোথাও গেলে কলেজে অধ্যাপনা করতে পারবেন না । সেই জন্য ওনাকে স্থায়ী ভাবেই থাকতে দিলাম ।ইতিমধ্যে ভাওয়ালের দিকের ওসমান নামে এম.এ পাশ এক ভদ্রলোক ও সালদৈ গ্রামের ডাঃ ছানাউল্লাহ সাহেবের আত্মীয় পরিচয় একজনকে কলেজে যোগদান করতে দিলাম ।
যারা পরবর্তীতে আমার বড় ভাই শিক্ষক মরহুম বি.টি সাহেব এবং মরহুম ইউনুস ভাই সাহেবকে নিয়ে কলেজের একতরফা হিসাব নিয়ে বললেন তুমি এতটাকা কলেজ থেকে নিয়েছ ।এসব কথা শুনে আমার মাথায় বাজ পড়ার মত অবস্থা হলো ।আমি হঠাৎ করে উনাদেরকে বলে ফেললাম ৩ মাসের ছুটি চাই – আমার শরীর ভাল না চিকিৎসা করতে হবে ।তখন তাঁরা মনে মনে বেশ রেগে গেলেন – এবং মনোহরদী থেকে রেভিনিও স্ট্যাম্প এনে আমার কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন এবং মরহুম ইউনুস ভাই সাবে বলেই ফেললেন, যাওনা ঢাকা, প্রিন্সিপালি পাবানা । নিজের হাতে গড়া কলেজের মুচলেকা দিয়ে থাকার পাত্র আমি নই ।
আপনারা শুনে অবাক হবেন আমি ঢাকায় আসার পরদিনই শহীদ স্মরণিকা কলেজের অধ্যক্ষ সাহেব আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, “ভাই সাহেব আমার দায়িত্ব নেন, আমি এর পারছিনা ।” ঐ ভদ্রলোক বয়স্ক ও অসুস্থ ছিলেন ।কাজেই চাকরি –বাকরী আল্লাহর ইচ্ছা । আমি যে বারবার ৭টি কলেজ করেছি বলে আসছি ঐগুলো হলো জামালপুর ডিগ্রি কলেজ, বঙ্গতাজ কলেজ, কেরানিগঞ্জ মহিলা কলেজ, পলাশ শিল্পাঞ্চল কলেজ, শাহজাহানপুর কলেজ এবং গোড়ান আদর্শ মহিলা কলেজ ।
খিরাটি হতে চলে আসার পরও আমি ৫/৬ মাস পর্যন্ত কলেজের সমস্ত
কাজ করে দিয়েছি – অডিট করে দিয়েছি যাতে কলেজটি টিকে থাকে ।কারণ এত কষ্টের করা কলেজ
– তখন মন্ত্রী সাহেবও নাই –যে কোন মুহূর্তে কলেজটি বন্ধ হয়ে যেতে পাড়ে । বহু কলেজ
আসে এভাবে Defunct হয়ে
গেছে । তবে নজরুল প্রফেসর কে খুব কষ্ট সত্ত্বেও ধন্যবাদ দেই এ কারণে যে তিনি আমার
কলেজটিকে টিকিয়ে রাখতে অনেক কষ্ট করেছেন ।তিনি অনুমান করুক আমরা খিরাটিবাসী অনেক
উদার, বাংলাদেশের যে কোন স্থানের মানুষের চেয়ে উন্নত চরিত্রের ।
No comments:
Write commentsNote: Only a member of this blog may post a comment.