গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার টোক ইউনিয়নের টোক নয়ন বাজারে টোক
বাজারের পূর্ব পাশে অবস্থিত বিখ্যাত নিরিবিলি হোটেল। গাজীপুরের কাপাসিয়া, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া আর
ময়মনসিংহের গফরগাঁও এর মিলন স্থানে এই টোক বাজার। বিখ্যাত হবার অন্যতম কারন এটি।
আর সবচেয়ে বড় কারন তোতা মিয়ার নিরিবিলি হোটেলের ৭০ ধরনের ভাজি ভর্তা।
আট ভাইয়ের সংসারে তোতামিয়ার পঞ্চম আর জন্ম
এই টোক নয়ন এলাকাতেই। প্রায় ২০ বছর আগে কক্সবাজের এক হোটেলে বয় হিসেবে কাজ শুরু
করেন, সেখান
থেকে চট্টগ্রামের একটি হোটেলে দীর্ঘদিন বাবুর্চি হিসেবে কাজ করেন। রান্নার হাত
ভালো থাকায় চট্টগ্রামের ওই হোটেলের সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি।
সাথে হোটেলের বিক্রিও বেড়ে যায়। তোতামিয়ার রান্নার খ্যাতি এই টোকের লোকজনের কানেও
পৌঁছে যায়। এক পর্যায়ে তারা তোতা মিয়াকে অনুরোধ করেন, টোক
নয়ন বাজারে একটি খাবারের হোটেল দেওয়ার জন্য।
সে অনুরোধে সাড়া দিয়ে সাত বছর আগে তোতা
মিয়া টোক নয়ন বাজারে নিরিবিলি পরিবেশে চালু করেন ‘নিরিবিলি হোটেল’
নামের এই হোটেলটি। তোতা মিয়া, তার ছেলে
মিলে চালান এটি। সব রান্নার তত্বাবধানে থাকেন তার স্ত্রী সালেহা বেগম। তিনি ও তার
স্ত্রী নিজে বাড়িতে রান্না করে হোটেলে নিয়ে আসেন। প্রতিদিন সব মিলিয়ে মোট ৭০ টি
আইটেম তৈরী করা হয়। সকাল ৮টা থেকে একটানা রাত ২টা পর্যন্ত খোলা থাকে তোতা মিয়ার
হোটেল।
তোতা মিয়ার নিরিবিলি হোটেলে আসতে হলে
ঢাকার গুলিস্তান (ফুলবাড়িয়া) থেকে ঢাকা পরিবহন, প্রভাতী বনশ্রী পরিবহন,
ঢাকার মহাখালী থেকে ভাওয়াল পরিবহন, জলসিড়ি
পরিবহন, সম্রাট পরিবহন, এগারসিন্দুর
পরিবহন, অনন্যা পরিবহন, বিআরটিসির
গাড়ি, অনন্যা ক্লাসিক পরিবহন, বন্যা
পরিবহন, উজান ভাটি পরিবহনের গাড়ি দিয়ে কাপাসিয়া হয়ে
টোক নয়ন বাজারে যেতে হবে। এছাড়া গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে সরাসরি রাজদূত বা পথের
সাথী পরিবহনের গাড়ি দিয়ে টোক নয়ন বাজারে যাওয়া যায়। মহাখালি থেকে টোক বাজারের
ভাড়া পড়বে ১১০-১৩০ টাকার মধ্যে।পথের ক্লান্তি অনেকটাই দূর হলো যখন গাজীপুর
ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্ক পাড় হয়ে যখন সবুজ রাস্তা ধরে বাস ছুটে চলল। রাজেন্দ্রপুর
ক্যান্টমেন্ট পাড় হবার পর দুইপাশে শুধুই সবুজ শালবন। মহাখালি থেকে জলসিড়িঁ পরিবহনে
টোকবাজার পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের প্রায় ৪ ঘন্টা সময় লেগে গেলো। টোক বাজার নেমে
বামে ২০০ গজ দুরেই নিরিবিলি পরিবেশে দেখা মিললো হোটেল নিরিবিলির।
হাত মুখ ধুঁয়ে রিতিমতো ঝাপিয়ে পড়লাম
খাওয়ার জন্য। খাবার মান আর স্বাদ নিয়ে শুধু একটাই কথা মনে হলো এতোও অমৃত। সবকিছুই
চেখে দেখার চেষ্টা করলাম,
রেখে দেবার মতো কোন আইটেমই চোখে পড়লো না। মনে রাখার মতো কিছু
আইটেম,
মাংশঃ হাসের মাংশ, মুরগীর মাংশ, কবুতরের মাংশ, খাশির মাংশ
মাছ: শোল মাছ, রুই মাছ, চিংড়ি মাছ, বাতাসী মাছ, বাইন মাছ, ইলিশ মাছ, গুড়া
মাছ, শুটকি মাছ
শাক: লাল শাক, পুই শাক, সর্ষে শাক, মুলা শাক, পাট শাক
ভর্তা: আলু ভর্তা, সর্ষে ভর্তা, কালো জিরা ভর্তা, শুটকি ভর্তা, মরিচ ভর্তা, ডিম ভর্তা,
আচার: বড়ই আচার, জলপাই আচার, মিক্সড আচার,
ডাল: মাসকালাই, মশুর ডাল, মুগ ডাল,
সবজি: ১২ রকমের মিক্সড সবজি, ঝিংগা,
চিচিংগা, পটল, আলুসীম, করলা।
ভড়পেট ভাত খেয়ে চোখে পড়লো হোটেলের সামনের
ছোট চায়ের
দোকান। র-চার অর্ডার হলো, চোখে পড়লো পানের উপরে। খোঁজ নিয়ে
জানা গেলো তার পান ও তোতামিয়ার হোটেল থেকে কম যায় না। ৪০ আইটেমের বেশি জিনিসের পান
তৈরি হয়। লোভ সামলাতে না পেরে সেই বিখ্যাত সেই শাহী পানের ও অর্ডার দেওয়া হলো।
আইটেম আর বানানো দেখে ২০ টাকা মুল্যের পান হিসেবে খুব কমই মনে হলো। পান খাবার পরে
মনে হলো আবার যদি আসি এই টোক বাজারে, এই পান না খেয়ে
ফিরবো না।
দুপুরের খাওয়া শেষে আরাম করে একটু ঝিমুনি
দিতে খুব মন চাইছিলো। নতুন যায়গা গিয়ে হাট পা গুটিয়ে বসে থাকার মতো আসলে আমরা না।
কি আছে আশে পাশে,
একটু খোঁজ নিয়ে জানা গেলো আমাদের পাশে ব্রহ্মপুত্র নদ আর তার
পাশেই ঈসা খাঁর বিখ্যাত দুর্গ এগারসিন্দু আর ইতিহাসের বিখ্যাত ঈশা খাঁ-মানসিংহের
যুদ্ধ। এই যুদ্ধ নিয়ে ইতিহাস থেকে যা জানা যায়,
১৫৯৬ সালে বার ভূঁইয়াদের অন্যতম ঈসা খাঁর
সঙ্গে মোগল সেনাপতি রাজা মানসিংহের দ্বন্দ্ব যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধ হয়
ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গমস্থলে বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার
সর্ব দক্ষিণ প্রান্তের টাঙ্গার গ্রামে।
সে সময় শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরে ছিল
রাজা মানসিংহের রাজধানী টোক নগরী। এটির অবস্থান গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার
উত্তর-পূর্বাংশে। রাজা মানসিংহ ১৫৯৫ সালে রাজস্থান থেকে তার রাজধানী টোক নগরীতে
সরিয়ে আনেন। ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যার সঙ্গমস্থলে ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীরে ছিল
টাঙ্গাব গ্রাম ও টোক নগর। ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পাড়ে ছিল ঈসা খাঁর বিখ্যাত দুর্গ
এগারসিন্দু।
ইতিহাস মতে, ঈসা খাঁর অনুপস্থিতিতে
মানসিংহ এগারসিন্দু আক্রমণ করেন। সংবাদ পেয়ে দুর্গ রক্ষায় ছুটে আসেন। কিন্তু তার
সৈন্যরা এতোই ক্লান্ত ছিল যে, তারা যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি
জানায়। ফলে ঈসা খাঁ মানসিংহকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান করেন। মানসিংহ এ প্রস্তাবে
রাজি হন। যুদ্ধে এক পর্যায়ে মানসিংহের তরবারি ভেঙে গেলে ঈসা খাঁ তাকে আঘাত না করে
নিজের তরবারি মানসিংহকে দেন কিন্তু মানসিংহ তরবারি না নিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে আসেন।
ঈসা খাঁ তখন মানসিংহকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান করেন। কিন্তু মানসিংহ তা গ্রহণ না করে
ঈসা খাঁকে আলিঙ্গন করেন। তার সাহস ও মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব
স্থাপন করেন। মানসিংহ ঈসা খাঁকে নিয়ে সম্রাট আকবরের দরবারে গেলে তিনি ঈসা খাঁকে ২২
পরগনার শাসক নিয়োগ করেন ও তাকে মসনদ-ই আলা উপাধিতে ভূষিত করে স্বদেশে ফেরত পাঠান।
তথ্য ও ছবিঃ Somewhereinblog