কাপাসিয়ার ধারাবাহিক ইতিহাস : পর্ব-২
অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটন

দুর্ভিক্ষ/দূর্ভিক্ষ : ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ বাংলার তথা ভারতের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নামে পরিচিত। ১১৭৬ বঙ্গাব্দে ( খ্রি. ১৭৭০) এই দুর্ভিক্ষ হয়েছিল বলে একে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ বলা হয়। এই মন্বন্তরের ভয়ংকর থাবা থেকে বাদ যায়নি কাপাসিয়া। এদেশে দুর্ভিক্ষের কথা জানা যায় মূঘল শাসন আমল থেকে। সুবেদার মীর জুমলার সময় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে বহু মানুষ মারা যায়। এ দুর্ভিক্ষের স্থায়ীত্ব কাল ছিল ২ বছর। দুর্ভিক্ষের ঢেউ লেগে ছিল কাপাসিয় সহ ভাওয়াল পরগণায়।
বৃটিশ শাসন আমলে বহুবার এ জনপদে দুর্ভিক্ষ ও মহামারি দেখা দিয়েছিল। ১৭৬৯ থেকে ১৭৭০, ১৭৮১ থেকে ১৭৮৪, ১৭৮৭ থেকে ১৭৮৮, ১৯০৬, ১৯৭৪ সালে এ অঞ্চলে দেখা দিয়ে ছিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। বিশেষ করে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে কাপাসিয়ার অনেক লোক মারা যায়। ১৩৫০ বঙ্গাব্দ বা ১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলায় যে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তা পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত। ইংরেজ সরকারের কিছু বিতর্কিত নীতি এবং উদাসীনতার কারণে এই দুর্ভিক্ষ ত্বরান্বিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান বার্মা দখল করে নিলে বার্মা থেকে বাংলায় চাল আমদানী বন্ধ হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় সরকার পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। অনুমান করা হয় এই দুর্ভিক্ষে বাংলায় প্রায় ৫০ লক্ষ লোক মারা যায়। পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় চালের দাম স্বাভাবিকের চেয়ে দশগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। সে সময় দেশি চাল ৬ টাকা মণ হতে ৬০-৭০ টাকা মণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। তৎকালীন সারা বৃটিশ ভারতে এ দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছিল। মানুষ-কুকুর-কাক ডাষ্টবিনের খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছিল। এখানে সেখানে পড়েছিল কঙ্কালসাড় মানুষ ও মৃত মানুষের লাশ। জীব-জন্তু, পশু-পাখি, গাছপালার মাঝেও দেখা দিয়েছিল বিরূপ প্রভাব। ভারত বর্ষে ১৯৪৩ সালের এ দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে সারা বিশ্বের কাছে খ্যাত হয়েছিলেন চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন।

১৭৮১ সালের দুর্ভিক্ষের সময় মানুষ গাছের ছাল, পাতা ও জলজ উদ্ভিদের শিকড় পর্যন্ত খেয়ে জীবন ধারণ করেছে বলে লোকমুখে জানা যায়। অনাহারে, অর্ধাহারে, খেয়ে না খেয়ে, রোগে-শোকে মারা গেছে অসংখ্য মানুষ।
১৭৮৭-১৭৮৮ সালে ভূমিকম্প ও বন্যার ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে কয়েক হাজার মানুষ না খেয়ে মারা যায়। ১৭৮৭-১৭৮৮ সালের দুর্ভিক্ষের সময় কার্পাস তুলার তৈরী বিখ্যাত মসলিন কাপড়ের বুনন শিল্পী-কারিগর, তাঁতী, কুমার, জেলে সম্প্রদায়ের অসংখ্য লোক মৃত্যুবরণ করে ছিলেন। সে সময় ইতিহাস খ্যাত মসলিন ও মৃৎশিল্প প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। অনাবৃষ্টি, প্রচন্ড খড়া ও তাপদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। পুকুর ও কুপের পানি শুকিয়ে যায়। খবার পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। শোনা যায়, সে সময় সূর্যের তাপে গাছের শুকনো পাতায় আগুন পর্যন্ত ধরে গিয়েছিল। সর্বশেষ ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় চাল, ডাল, লবণ সহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। মা্নুষকে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। ভাতের মার ও আটার জাও খেতে হয়েছে অনেককে। যেতে হয়েছে লঙ্গর খানায়।


খাল-বিল, নদী-নালা বেষ্টিত কাপাসিয়া অঞ্চলে বহুবার বন্যা ও প্লাবন হয়েছে। স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৭০, ১৯৭৪ সালে কাপাসিয়ায় ব্যাপক বন্যা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর এ অঞ্চলে ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪ সালে ভয়াবহ বন্যা হয়। এর মধ্যে ১৯৯৮ সালের বন্যা ছিল গত কয়েক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী। ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যায় বিভিন্ন গ্রামের বহু কাঁচা ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়। পশুসম্পদ ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। দেখা দেয় নদী ভাঙ্গন। রাস্তা-ঘাট ভেঙ্গে যায়। অনেক চর ও নীচু অঞ্চলের মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেয়। এ বন্যার সময় নিহত মানুষগুলোর মধ্যে কারো কারো কবর হয়েছে রাস্তায়, যা এখনো দেখা যায়।

ফি বছর কাপাসিয়ার উপর দিয়ে একাধিকবার প্রবল বেগে ঝড়-তুফান, ঘুর্নিঝড়, কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যায়। এছাড়া টাইফুন বা সাইক্লোন, টর্নেডো মতো শক্তিশালী প্রাকৃতিক দুর্যোগও মাঝেমধ্যে দেখা দেয়। এতে করে কাপাসিয়ার অনেক গ্রাম লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। মানুষ হারায় নিরাপদ আশ্রয়। ফসল ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়। কাপাসিয়ায় ঘুর্নিঝড়ের মধ্যে ১৯৬১, ১৯৬৫, ১৯৬৯-১৯৭০, ১৯৯১ সালের ঘুর্নিঝড় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে কাপাসিয়ায় কত লোকের প্রাণহানি হয়েছে কিংবা কী পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তার সঠিক হিসাব জানা যায়নি।

২০০৩ সালে উপজেলার ঘাগটিয়া ইউনিয়নের কামারগাঁও গ্রামসহ আশ-পাশের বেশ কয়েকটি গ্রামে রাতে ভয়াবহ ঘুর্নিঝড় বয়ে যায়। আধা ঘন্টা স্থায়ী এ ভয়াবহ ঘুর্নিঝড়ে গভীর নলকুপ ছিড়ে নিয়ে যায়, ঘরের টিলের চাল, আসবাব ও বিছানাপত্র বহু দূর পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে যায়। ২০১৪ সালে উপজেলার বারিষাব ইউনিয়ন, ২০১৫ সালের বৈশাখে টোক ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুর্নিঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ঝড়ে উচুঁ গাছের ডালে আটকে থাকে টিনের চাল। পানের বরজ, ঘর-বাড়ি, পোল্ট্রিফার্ম, বাজারের দোকান-পাট উপড়ে ফেলে। ভেঙ্গে ফেলে গাছপালা। বসত ঘরের সাথে বহু স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা ভবনও মাটির সাথে মিশে যায়।
বজ্রপাত বা বাজ পড়া : গাজীপুরের কাপাসিয়ায় কালবৈশাখী ঝড়ের সময় বজ্রপাত বা বাজ পড়া প্রকৃতির রুটিন কাজ বলা যায়। প্রতি বছরই কাপাসিয়া এলাকায় বজ্রপাতে’লোকের প্রাণহানি, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত, গবাদিপশুর প্রাণহানি ও ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি হয়। উপজেলার সনমানিয়া, চর মনোহরদী, বারিষাব, লোহাদী, পাঁচুয়া, বাড়ৈগাঁও, রাওনাট গ্রামসহ অনেক গ্রামেই বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু খবর পাওয়া যায়। এ সময় প্রচুর বৃষ্টিপাত সহ প্রচন্ড শক্তিসম্পন্ন দমকা হাওয়া বয়ে যায় এবং বজ্র বিদ্যুৎ চমকায়। অনেক সময় এই অঞ্চলে বিনা ঝড়-তুফান-বৃষ্টিতে বজ্রপাত হয় বলে জানা গেছে। দিন দিন বজ্রপাতের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বজ্রপাতে টেলিভিশন, ফ্রিজসহ ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতির ক্ষতি হচ্ছে। অনেকের ধারণা, বৃটিশ আমলে স্থাপিত সীমানা পিলার চুরি হয়ে যাওয়ায় আগের চেয়ে বেশি বজ্রপাত বেশি হচ্ছে। বজ্রপাতের সাথে শীলা বৃষ্টিতে ফল-ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্চে।

আর্সেনিক : একটি মৌলিক পদার্থের নাম আর্সেনিক(Arsenic), যার রাসায়নিক সংকেত As এবং পারমাণবিক সংখ্যা ৩৩। কাপাসিয়া উপজেলার অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে খাবার পানিতে আর্সেনিকের মাত্রাতিরিক্ত হার প্রমাণিত হয়েছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। পানিতে স্বল্প মাত্রায় আর্সেনিক সব সময়ই থাকে। কিন্তু যখনই এই মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশি হয়ে যায়, তখনই তা পানকারীর শরীরের নানা রকম রোগের উপসর্গ তৈরি করে এবং পরবর্তীতে সেই সকল রোগব্যাধিকে মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুও হতে পারে। উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম আর্সেনিক দূষণের শিকার এবং বহু সংখ্যক নলকূপের পানিতে বাংলাদেশের মানের চেয়ে বেশি মাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে। দিনে দিনে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে চলেছে। উপজেলায় গত ১০ বছরে অন্তত: ৩ জন আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

ভূমিকম্প : কাপাসিয়ার ভূমিকম্প, ভূমিধস ও ভূমি ফাটল বিচ্ছিন্ন কোনো ইতিহাস নয়। এগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসেরই অংশবিশেষ। এক সময় কাপাসিয়া ঢাকা জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখনকার এক ভূমিকম্পের ভয়াল চিত্র আজো আমাদের পীড়া দেয়। সেই দিনের ভূমিকম্প নিয়ে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ যতীন্দ্র মোহন রায় তাঁর ‘ঢাকার ইতিহাস’- গ্রন্থে লিখেছেন, “১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ১২ জুন তারিখের ভূমিকম্পে জেলার উত্তরাংশের অনেক খাল-বিলের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। বহু ভবন, ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ভূ-কম্পনের ফলে ঢাকা-ময়মনসিংহের রেল লাইন ভেঙ্গে গিয়েছিল।” জানা যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে কাপাসিয়ার পূর্ব সীমানা দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদটি ভরাট হয়ে যায় এবংনদটিতে চর জেগে উঠে। ১৯০১ সালেও অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছিল। সে ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্রের গতি পরিবর্তন হয় বলে জানা যায়। বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র নদটি মরা ও সরু খালে পরিণত হওয়ার ঘটনা ভূকম্পনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বাংলা ১১৩৮, ১১৮১, ১২১৮, ১২৫৩, ১২৫৭, ১২৫৯, ১২৭০, ১২৭৮, ১২৯৭ সনে এ অঞ্চলে ভূকম্পন হয়েছিল বলে জানাযায়। তন্মধ্যে ১১৮১ ও ১২১৮ সনের ভূমি কম্পন ছিল খুবই শক্তিশালী। ইংরেজি ১৭৬২, ১৭৭৫, ১৭৮৭, ১৮১২, ১৮৭৬, ১৮৮৭, ১৮৯৭ সালে এ অঞ্চলে ব্যাপক ভূমি কম্পন হয়েছিল।
২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভারত মহাসাগরের তলদেশে আঘাত হানা সুনামিতে দুলাখ ৮০ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। সুনামিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো ইন্দোনেশিয়ার আচেহ্ প্রদেশে। আচেহ প্রদেশের রাজধানী বান্দা আচেহ সেই শক্তিশালী ভূমিকম্প ও জলোচ্ছাসে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। স্মরণকলের এই ভয়াবহ সুনামির ব্যাপক প্রভাব পড়ে ছিল কাপাসিয়া উপজেলার সর্বত্র। ওই সুনামির ফলে কাপাসিয়ার খাল-বিল, নদী-নালার পানি হঠাৎ উপরে ফুসে গিয়েছিল। পাড়ে আচড়ে পড়েছিল পুকুর-ডোবার পানি। লাফিয়ে উঠে ছিল মাছ। ভয় ও অাতংকে কিংকর্তব্যবিমোঢ় হয়ে পড়েছিল মানুষ।
ভূমিকম্পের সংজ্ঞাটা অনেকের জানা না থাকলেও, ভূ-পৃষ্ঠ কেঁপে উঠলে ভূমিকম্প হয়েছে, এটা সবাই বুঝেন। সাধারণভাবে বলা যায়, ভূ-অভ্যন্তরে শিলায় পীড়নের জন্য যে শক্তির সঞ্চয় ঘটে, সেই শক্তির হঠাৎ মুক্তি ঘটলে ভূ-পৃষ্ঠ ক্ষনিকের জন্য কেঁপে উঠে এবং ভূ-ত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়; এরূপ আকস্মিক ও ক্ষনস্থায়ী কম্পনকে ভূমিকম্প (Earthquake) বলা হয়। কম্পন-তরঙ্গ থেকে যে শক্তির সৃষ্টি হয়, তা ভূমিকম্পের মধ্যমে প্রকাশ পায়। এই তরঙ্গ ভূ-গর্ভের কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে উৎপন্ন হয় এবং উৎসস্থল থেকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভূমিকম্প সাধারণতঃ কয়েক সেকেণ্ড থেকে এক/দু-মিনিট স্থায়ী হয়। মাঝে মাঝে কম্পন এত দূর্বল হয়, তা অনুভব করা যায় না। কিন্তু শক্তিশালি ও বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে। ‘ভূমিকম্প’ শব্দটিকে আজকাল কেউ কেউ ‘ভুমিকম্প’ লেখেন। ভূকম্পন, ভূ-কম্পন, ভুকম্পন, ভুমিকম্পন, ভূমিকম্পন, ভুমি কম্পন, ভূমি কম্পন এই শব্দগুলির অর্থ একই, পার্থক্য কেবল বানানে।
এদিকে, চলতি বছর (২০১৫ সালের) ২৫ এপ্রিল শনিবার ভূকম্পনে কেঁপে উঠে গোটা উপমহাদেশ৷ভূমিকম্পের উৎসস্থল নেপাল৷রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা ৭.৯৷ বিগত ৮০ বছরের মধ্যে হিমালয়ের কোলে অবস্থিত দেশগুলিতে এটিই সব চেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প৷এতে করে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে দশ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। গোটা কাঠমান্ডু শহরটাই পরিণত হয় ধ্বংসস্তুপে।
রাজধানী সহ সারা দেশের ন্যায় কাপাসিয়ার সর্বত্র ওই দিন দুপুর সোয়া ১২টার দিকে হঠাৎ প্রচন্ড ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। ফলে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, হাট-বাজার, অফিস পাড়ায় তাৎক্ষনিক ভাবে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। যে যখন টের পেয়েছে একবারের জন্য হলেও নড়েচড়ে বসেছে। কাপাসিয়া শহরের মেইন রোডের বড়-বড় ভবন বা বিপনী বিতানে অবস্থানরত লোকজন আংতকে রাস্তায় নেমে আসে এবং দিকবিদিক ছুটাছুটি করতে থাকে। এ সময় দেখা যায় বিদ্যুতের তার এবং খুটিতে লাগানো ট্রান্সমিটার অনবরত নড়ছে। নদী, পুকুর ও ডোবার পানি এদিক-সেদিক দোলছে। কোথাও-কোথাও মাছের খামারের মাছ গুলো পানির উপরে লাফাচ্ছিল।
কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস করার সময় তাদের মাঝে ভূ-কম্পন অনুভূত হলে আতংকে ছুটাছুটি ও মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়ে অন্তত পক্ষে ১৮ জন এবং বীর উজলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ২ ছাত্রী পড়ে গিয়ে আহত হয়। ভুমি কম্পনের সময় কাপাসিয়া থানায় অবস্থানরত সকল পুলিশ ও কর্মচারীবৃন্দ আতংকে ভবন ছেড়ে দ্রুত খোলা মাঠে বেরিয়ে আসে। মানুষ ভয়ে ঘর-বাড়ি বাইরে বেরিয়ে আসে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক শ্রেণি কক্ষ ছেড়ে চলে আসে খোলা মাঠে। তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে অনেকেই আহত হয় এবং ভয় ও আতংকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
ভূমিধস : বাংলাদেশে প্রাণঘাতি দুর্যোগগুলোর মধ্যে আশংকাজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ভূমি ধসকে। ভূমি ধসে মূলতঃ ভূমির ব্যাপক উলোট পালোট হয়ে থাকে। এর ফলে একটি বিস্তৃত এলাকার পাথর, গাছপালা ও মাটি উপর থেকে ধসে পড়ে আবার অনেক সময় মাটি নীচে দেবেও যায়। এছাড়াও অনেক সময় পাহাড় বা উচু স্থানের উপর থেকে পানি ও মাটি মিশে কাদা আকারে বিপুল পরিমাণে নীচে নেমে আসলে তাকেও এক ধরনের ভূমি ধস আখ্যা দেয়া হয়। অনেক কারণ রয়েছে যেগুলো একটি এলাকাকে ভূমি ধস প্রবণ করে তুলতে পারে এবং কেড়ে নিতে পারে মানুষের জীবন ও সম্পদ। ‘ভূমি ধস’-এর ইংরেজি Landslide, বাংলায় যার প্রচলিত অন্যান্য বানানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ভূমি ধ্বস, ভুমি ধ্বস, ভুমি ধস, ভূমিধস, ভূমিধ্বস, ভুমিধ্বস, ভুমিধস।
কাপাসিয়া উপজেলায় ভূমি ধস ও ফাটলের ঘটনা নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দশ বছর আগে ১৯৬২ সালে উপজেলা সদরইউনিয়নের দস্যুনারায়ণপুর গ্রামে বড় মাপের ভূমি ধস হয়। তারপর উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় আরো কিছু ভূমি ধসের ঘটনা ঘটে। তবে ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে নারায়নপুর বাজার সংলগ্ন দাস পাড়ায় শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে প্রভাতে আকস্মিক ভূমি ধসের ঘটনা দেশ ব্যাপি তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। তখন ওই পাড়ার সংলগ্ন বিশাল এলাকা ২৫-৩০ ফুট নীচে দেবে গিয়েছিল। এতে বাড়ি-ঘরের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। এ ভূমি ধস দেখার জন্য দেশ-বিদেশের অনেক সাংবাদিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের কয়েকজন অধ্যাপক, গবেষক, ভূগোলবিদ, প্রত্মতত্ববিদ ও সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ ঘটনাস্থলে ছুটেে আসে। তাঁরা অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনকে কাপাসিয়ার নদ-নদীর আশপাশে ভূমি ধসের কারণ বলে উল্লেখ করেছিলেন। এছাড়াও এ ভূমি ধসের কিছু মানব সৃষ্ট ও প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে বলে জানা যায়।
ওই ঘটনার দশ বছর পর ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে আবারো দস্যুনারায়ণপুর গ্রামে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ফের ২ হাজার বর্গমিটার ভূমি দেবে যায় এবং অনেক জায়গায় ফাটল দেখা দেয়। প্রায় ৩শ’ ফুট দীর্ঘ ও স্থান ভেদে ১৫ থেকে ২০ ফুট চওড়া হয়ে প্রায় ৩০ ফুট নীচে ভূমি দেবে পার্শ্বের শীতলক্ষ্যা নদীর দিকে চলে যায়। বৃহৎ আকার মাটির খন্ডগুলোতে কাঁঠাল, আম, বাঁশ ও অন্যান্য গাছ নদীতে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে এবং কিছু জায়গা নদীতে ধসে যায়।

ভূমি ফাটল: কাপাসিয়া অঞ্চলের ভূ-পৃষ্ঠ ফাটলের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানা গেছে। ভূমি ফাটল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ২০১৩ সালে হঠাৎ করে উপজেলার বারিষাব ইউনিয়নের রায়েদ এলাকায় মাটি দেবে যায় ও ফাটল দেখা দেয় ৩ কিলোমিটার জুড়ে। ২ থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত মাটি দেবে গিয়ে এলাকায় সৃষ্টি হয় আতংক। রায়েদ পূর্ব পাড়া থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত মাটি সর্বোচ্চ ফাঁক হয়ে যায়। মাটি দেবে যাওয়া ও ফাটলের ফলে বিপুল সংখ্যক ঘরবাড়ি, গাছপালা ও বিভিন্ন স্থাপনার ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে উপজেলার রাওনাট, দড়িনাশেরা এলাকায় বড় ধরণের ভূমি ফাটলের ঘটনা ঘটে। দড়িনাশেরা গ্রামের মাস্টার জহিরুল হকের বাড়ি সংলগ্ন বিশাল ভূমি ফাটলের অংশে কান পাতলে পানি প্রবাহের শব্দ শোনা যায়। ভূমি ফাটলের ঘটনায় গ্রামবাসীর মধ্যে ভয় ও আতংক বিরাজ করে। উৎসুক মানুষ ফাটল দেখার জন্য ঘটনাস্থলে ভীড় জমায়।
বৃক্ষ নিধন, খাল-বিল, নদী-নালা ভরাট হয়ে যাওয়া সহ নানা কারনে কাপাসিয়াও জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। সূর্যের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ষড়ঋতুর পরিবর্তে গ্রীষ্ম ও শীত এই দুই ঋতুই প্রধানতঃ লক্ষণীয় হয়ে উঠছে। কাপাসিয়ায় প্রকৃতি রক্ষা ও প্রাকৃতিক দুর্যেোগ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
পরবর্তী প্রতিবেদন : কাপাসিয়ার লোকসংস্কৃতি, লোকবিশ্বাস ও কুসংস্কার
No comments:
Write commentsNote: Only a member of this blog may post a comment.